১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশের সময় এক গ্রীষ্মের বিকেল, পটভূমিকা আগ্রা ।
সারাদিন কেমন বদ্ধ গরম ছিল আজ, এখন বিকেলের দিকে হালকা উদাস উদাস হাওয়া বইছে দক্ষিণ দিক থেকে । মোঘল প্রাসাদের বিশাল অলিন্দ দিয়ে এক মনে হেঁটে চলেছেন উস্তাদ মনসুর, গর্বিত অথচ ধীর পদক্ষেপে । হাতে এক খানি হালকা পাকানো কাগজ । প্রাসাদের এই অংশে রাজপরিবারের বিশেষ কাউকে এখন চোখে পড়লো না উস্তাদজীর, অথচ সম্রাট তো তাকে এখানেই দেখা করতে বলেছেন । কিছুদিন ধরেই যে ছবি আঁকার কাজটা করছিলেন তিনি, সেটা নিয়ে হয়তো নিশ্চিন্তে দুটো কথা আলোচনা করার জন্য ।
অনেকেই আরো আছেন চিত্রকর রাজসভায় – আবুল হাসান, ফাররুখ বেগ, গোবর্ধন, ইনায়েত, মনোহর ,মুহাম্মদ নাদির ইত্যাদি । বিশাল তাঁদের প্রতিভা, যশ প্রতিপত্তি, কিন্তু সেলিম যখনই তাঁর বিশেষ কোনো প্রিয় পাখি বা পশু আঁকানোর কথা ভাবেন, যেন সবচেয়ে ভরসা করেন উস্তাদজীকেই । রাজসভায় সকলেই সেই কথা জানেন । হয়তো কিছু ঈর্ষাও আছে তার জন্য । সবাই বলে উস্তাদজীর তুলি যেন কথা বলে । যে আঁকাতেই হাত দেন, একদম জীবন্ত যেন । আর হবেনই বা কেন, সম্রাট সেলিম ওরফে জাহাঙ্গীর জানেন কিভাবে তাঁর প্রিয়তম শিল্পীর তুলি দিয়ে সেরাটা বার করে নিতে হয় । তিনি নিজেও পশু পাখি সম্বন্ধে খুব জ্ঞানী, নতুন কোনো জাতের পাখি বা জন্তু দেখলেই উনি সেটা সংগ্রহ করেন আর উস্তাদজীর তলব পরে সেটা আঁকার জন্য । নতুন কিছু দেখলেই সম্রাট সেটা লিখে রাখেন । গলা আর মাথার কিছুটা লাল রঙের, পুরো সাদা শরীরের উঁচু সারস পাখিটি (এখনকার নাম : সারস ক্রেন) কিভাবে খায়, কিভাবে জোড় বাঁধে, ভালোবাসে, ডিম পারে, সন্তান বড়ো করে, সবকিছু দেখে নিজে লিখে রেখেছিলেন সম্রাট । এমনি আরো কতকিছু… এই ব্যাপারে বাকিদের কথা একদমই শোনেন না । অন্যদের থেকে শোনা কথা আলাদা করে লেখেন আর নিজের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা করে । উস্তাদজী শুনেছেন সম্রাটের প্রপিতামহ সম্রাট বাবর এমন ছিলেন, পশু পাখি গাছপালার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত । ভারী ভালো লাগে তাঁর । প্রাসাদের গায়ে, প্রতিটা কোনায় অস্ত্রের ঝনঝন, হিংসা, দলাদলি, রক্তের গন্ধের মধ্যে যেন এক টুকরো প্রাণের স্পর্শ, যেন ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চুপ করে তার হৃদস্পন্দন শোনার মতন পবিত্র । এই টুকু না হলে শিল্পীমন বাঁচে কি করে, তুলি চলবে কি করে!
মনসুর মিঞা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকালেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন একটা মোটা স্তম্ভের সামনে । বাঁ হাত জেবের ভিতর থেকে বার করে হাতখানি রাখলেন স্তম্ভের গায়ে । আহা কত দিন! কত বছর পার হয়ে গেলো এই রাজসভায়! এই বিত্তশালী ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য্যের মধ্যে, সেই আকবর বাদশার সময়ের কথা মনে পরে । দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাদশার পুত্র সুদর্শন তরুণ সেলিম, বাদশার প্রানের ‘শিইখু বাবা’ । মুঘল শাহজাদা হয়েও যেন তিনি সবার চেয়ে একটু হলেও আলাদা । হিংসা হানাহানির চেয়ে জীবনের নরম গভীর গুণগুলি যেন তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । প্রবল পরাক্রান্ত পিতা বাদশাহ রাগ করবেন জেনেও আনারকলির প্রতি আবেগ লুকাতে পারেননি। সুন্দরী, সুরসিকা, বুদ্ধিমতী মেহের-উন-নিসার শাদীর পরেও মনে মনে পোষণ করেছেন তাঁর প্রতি প্রেম । মেহের-উন-নিসার খসম শের আফগানের মৃত্যুর পেছনে কার হাত আছে, সে জানতে আর কারুর বাকি নেই । মেহের-উন-নিসা এখন জাহাঙ্গীরের নুরজাহান । সম্রাট নুরজাহান বলতে অন্ধ । রাজপরিবারের কান্ডকারখানা তো আর কম নয় । কেউ স্বীকার করেনা, কিন্তু সবাই জানে এই কথা ।
মনসুর মিঞা ও জানেন হয়তো অনেকের মতনই কিংবা একটু বেশি, কিন্তু তিনি চুপচাপ নিজের কাজ করে যান । সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে খুব সন্মান দেখান, গুণী শিল্পীর কদর করে তাঁর উপাধি দিয়েছেন ‘নাদির-আল-আসার’, মানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ । সেই জমকালো ঝকঝকে দিনটার কথা মনে পড়লো উস্তাদজীর, ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি খেলে গেলো ।
‘সেলাম আলাইকুম, বাদশা আমাকে স্মরণ করেছেন?’ সুসজ্জিত কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে বললেন উস্তাদ মনসুর ।
‘আলাইকুম সেলাম, আইয়ে উস্তাদজী, তাশরীফ রাখিয়ে’ ।
গাঢ় সবুজ মখমলি ঝলমলে পোশাক সম্রাটের গায়ে, সযত্ন লালিত সরু নিম্নগামী গোঁফের প্রান্ত, মায়াবী সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি জানলার বাইরের দিকে রেখেছেন । জানলার বাইরে দুটি সাদা মাসাক্কালি পাথরের জালি জালি কারুকার্য্যের ফাঁকে ফাঁকে পা রেখে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে, খেলছে, এ ওর মাথায় ঠোঁটের চিরুনি বোলাচ্ছে, সম্রাট উপভোগ করছিলেন সেই দৃশ্য । উস্তাদজী বসলেন । সম্রাট ইশারায় সুন্দরী পরিচারিকাদের সরে যেতে বললেন । আসলে গোপন আলোচনা কিছু নয়, কিন্তু ওরা এই শিল্পকলার কদর বুঝবে না আর সম্রাট চাইছেন একদিন জাঁকজমক করে রাজসভায় সবার সামনে এই ছবি উন্মোচন করতে । এখনই সকলে দেখে ফেললে সেই ব্যাপারটা হবেনা ।
অনাবশ্যকভাবে গলাটা একটু নামিয়ে সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন ‘উস্তাদজী ছবিটা এনেছেন?’
‘জি জাহাঁপনা’ উস্তাদজী পাকানো কাগজটা মেলে ধরলেন সামনে । পাতাজোড়া বিশাল সাইবেরিয়ান সারস (এখনকার নাম : গ্রেট হোয়াইট ক্রেন) । অপূর্ব সে চিত্র । সারসের প্রতিটি পালক, শরীরের প্রতিটি রেখা যেন প্রাণবন্ত। পায়ের নখের ফাঁকে আলগোছে আটকে আছে একটি পালক । এতো তুচ্ছ জিনিসও শিল্পী খেয়াল করে তাঁর তুলিতে ধরেছেন অবলীলায় ।
উল্লসিত কণ্ঠে সম্রাট বলে উঠলেন ‘বাহঃ বাহঃ বহত খুব !’ নির্নিমেষ নয়নে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন পালকের রং, ডানার বিস্তার, গলার দৈর্ঘ্য ।
‘আপনি এ ছবি এখন রেখে যান, আমি একটু পাখিটার সাথে মিলিয়ে দেখবো’ ।
উস্তাদজী জানতেন এমনটাই হবে । সম্রাট তাঁর শিল্পগুণকে বিশ্বাস করেন কিন্তু পাখির সামনে থেকে দেখে ছোটোখাটো শারীরিক বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখবেন । এই ব্যাপারে তিনি একজন খাঁটি পক্ষী বৈজ্ঞানিকের মতনই খুঁতখুঁতে । আজকাল সবাই সম্রাটের এই পশু পক্ষী প্রীতির কথা জেনে গেছে । দূরদেশ থেকে নজরানা আসে প্রায়ই । সম্রাট ওগুলি খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন । সব কিছু লিপিবদ্ধ করেন, তারপর তার ছবি আঁকার দায়িত্ত্ব পরে উস্তাদ মনসুরের ওপর । ডোডো পাখির বিখ্যাত ছবিটিও এইভাবেই আঁকা । পর্তুগিজ অধীনস্ত গোয়া থেকে সুরাট হয়ে এই পাখি এসে পৌঁছেছিল জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ।
উস্তাদজী উঠলেন – ‘আমাকে তবে এবার অনুমতি দিন’ ।
সম্রাট ততক্ষনে আবার জানলার বাইরে দেখছেন । বাইরে আলো কমে আসছে, মাসাক্কালি দুটি তখনও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত । সম্রাট সেদিকে চেয়ে তরল মায়াময় উদাস কণ্ঠে বললেন ‘উস্তাদজী, সব আসল পাখির পাশাপাশি আপনার মনের রং মিশিয়ে কাল্পনিক পাখির ছবি আঁকাগুলিও থামাবেন না । আসল জীবনের পাশে একটা করে আসলের মতন জীবন থাকুক,যার গায়ে বাস্তবের কঠিন স্পর্শ লাগেনা, যার অতো নিখুঁত হবার তাড়া নেই । আপনার রঙে রেখায় আমার কাল্পনিক মনের বন্ধনমুক্তি হোক । সম্রাটের কণ্ঠে কি যেন একটা আর্তি ।
উস্তাদ মনসুরের বয়স হয়েছে অনেক । সম্রাটকে দেখছেন বহুদিন, তাঁর পিতার আমল থেকে । সেলিম থেকে জাহাঙ্গীর হবার পথটুকু সহজ তো ছিলোনা । উস্তাদজী হাসলেন, মৃদু সম্মতিসূচক একফালি হাসি । মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে পিছু হটে বিদায় নিলেন ঘর থেকে ।
*******
সাইবেরিয়ান সারস আগে ভারতে শীতকালে মাইগ্রেট করে আসতো, এখন আসা বন্ধ হয়েছে । এই ছবিটি ১৬১৬ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আঁকা । অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই সময়ের প্রায় ১৬০ বছর পর পশ্চিম সভ্যতার সামনে প্রথম আবিষ্কৃত হয় এই পাখি। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রুশিয়ান জুলোজিস্ট পিটার সাইমন পাল্লাস প্রথম এই সারসের নামকরণ করেন ।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ সময় আতসকাঁচের মাধ্যমে এই সারসের ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে এর অদ্ভুত ডিটেলিং দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অয়েল ক্যানভাস ছেড়ে কাগজ ও গুয়াশ রঙে ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নেন ।
কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে পেইন্টিং গ্যালারিতে এখনো সংগ্রহীত আছে এই ছবি ।
সাথে ইন্টারনেট থেকে নেওয়া শিল্পীর আঁকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছবি এবং উস্তাদ মনসুরের আঁকা ছবি দিলাম ।
একজন পক্ষীপ্রেমী ও চিত্রশিল্পী হবার দরুন এই বিষয়টি আমাকে খুব আকর্ষণ করছিলো । লেখার তথ্যগুলি ঐতিহাসিক ভাবে সত্য, ওগুলিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে গল্পের আকারে সাজিয়েছি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে ।
I have read so many posts concerning the blogger lovers but this paragraph is genuinely a fastidious piece of writing, keep it up.
Thanks a lot