Imprinting behavioral studies on birds
ছোটবেলায় দাদুর বাড়ির সামনে এক পাড়াতুতো মাসিকে দেখেছি এক চড়াই ছানা পুষতে। অনেকদিন আগেকার কথা। চড়াইয়ের বাসা থেকে তুলে আনা কিংবা ঝড়ের কবলে পড়া সে ছানার অতীত বর্তমান কিছুই মনে নেই আজ আর। মনে আছে কেবল সে ছানার অতিরিক্ত মনুষ্যপ্রীতি। বিশেষতঃ ওবাড়ির কনিষ্ঠা কন্যার প্রতি তার আনুগত্য। আমি অনেকদিন আমার দাদুর বাড়ি গিয়ে দেখেছি ওই মেয়েটির সাথে সে চড়াই, দাদুর বাড়ি এসে বসে আছে, ভাত খাচ্ছে। সে মেয়েটি চলে গেলে ও আর একমুহূর্তও থাকবে না এখানে । সবাই বলতো দারুন পোষ মানা চড়াই। জানি না, হয়তো তাই। সে মেয়েটিকে আমি মাসি ডাকতাম। নিজেও তখন ছিলাম নিতান্ত শিশু। এখন আর সেই চড়াইয়ের কথা ভালো মনে পড়েনা। তবে পোষ মানার ব্যাপারটা হয়তো এতদিন নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলাম যদিনা ইমপ্রিন্ট শব্দটার সাথে পরিচিত না হতাম সম্প্রতি।
গ্রে ল্যাগ গিজের ওপর গবেষণা করা, বৈজ্ঞানিক কনরাড লরেঞ্জের মতে পাখিরা নাকি জন্মের পর ১৩-১৬ ঘন্টা একটা সেনসিটিভ লার্নিং পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যায়, এই সময়ে তারা তাদের পিতামাতাকে ইমপ্রিন্ট করে অর্থাৎ তাদের বৈশিষ্ট্য গুলি নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করে নিজেদের অস্তিত্ব এবং প্রজাতির সম্বন্ধে দৃঢ় ভাবে জানে ও মানসিকভাবে নিজের অস্তিত্বকে সেই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করে, মানে ডিম ফুটে বেরোলো আর ইমিডিয়েটলি বুঝে ফেললো যে সে অমুক পাখি হয়েছে এমন ঠিক নয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য। সাইকোলজি আর ইথোলজির গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো ‘ফিলিয়াল ইমপ্রিন্টিং’, মানে বাবা মা কে দেখে কপি করা । ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডগলাস স্পাল্ডিং সাহেব প্রথম পোষা মুরগীর বিহেভিয়ার স্টাডি করে এই ব্যাপারটা সর্বসমক্ষে আনেন। তারপর বহু গবেষণা, দেশে বিদেশে বহু বৈজ্ঞানিকরা এই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা, সেসব তথ্যের কচকচানি থাক বরং। পাখিদের এই ইমপ্রিন্টিংয়ের ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখা যায় সেইসব শাবকদের মধ্যে যারা জন্মের পর খুব তাড়াতাড়ি নিজে খেতে শেখে বা বাসা ছেড়ে বেরোয়। মা বাবা কে দেখে তেমনি অন্ধ অনুকরণ এই ক্ষেত্রে সেই শাবকের দীর্ঘায়ুর ক্ষেত্রেও খুব উপযোগী, কারণ প্রাকৃতিক ভাবে তাকে তো ঐভাবেই বাঁচতে হবে। দেখা গেছে পিতামাতার বা সহোদর, সহোদরার গাত্রবর্ণের সাথে মিলিয়ে পাখির বাচ্চারা বড়বেলার সঙ্গীও নির্বাচন করে। এপর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, মানুষরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকটা পাখিদের মতনই, যদিও তার কার্যকারণ সম্পূর্ণ আলাদা। মানবশিশুও অনুকরণ করতে করতে নিজস্বতা শেখে, কিন্তু প্রকৃতি তাকে বুদ্ধি দিয়ে বড়োলোক করেছেন, পাখির শিশুর সাথে তার সম্পূর্ণ সরলীকরণ তাই হবেনা ।
এবার এই অব্দি সব ঠিকঠাকই ছিল। আপনার খোকাখুকি আপনার মতনই হবে, আপনাকে আদর্শ করে সে সঙ্গী নির্বাচন করবে এটা স্বাভাবিক। সে জন্মের পর আপনাকে ইমপ্রিন্ট করেই হোক বা জিনগত কারণে। কিন্তু মুশকিল হলো পাখির বাচ্চারা আবার ওই ক্রিটিকাল পিরিয়ডে যাকে সামনে দেখে বা যে বস্তুকে সামনে দেখে তাকে ইমপ্রিন্ট করে তার মতন হয়ে যায় । খাঁচায় জন্মানো পাখির বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মানুষের সংস্পর্শে আসাটা খুব স্বাভাবিক, তখন সে বাচ্চা মানুষকে ইমপ্রিন্ট করে তার মতন হতে চায় ।
এই ব্যাপারটা খুবই সংবেদনশীল । মানুষকে ইমপ্রিন্ট করা পাখি মানুষের প্রতি যে খুব ফ্রেন্ডলি হবে তা নয়, বরং পাখিদের স্বাভাবিক ভয় ব্যাপারটা চলে যায় এবং অনেকসময় মানুষের প্রতি আক্রমণাত্মকও হয়ে যায় । আসলে সে তখন মানুষের শ্রেণীভুক্ত মনে করে নিজেকে । নিজের আসল গোষ্ঠীর সাথে ভাবের আদানপ্রদান তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যায় । বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানা বা রেসকিউ সেন্টারে এরকম অনেক হতভাগ্য পাখি আছে যাদের মানুষের ওপর ইমপ্রিন্টিং হয়েছে যেমন, ‘এডি’ নামের একটি আমেরিকান কেস্ট্রেল, ‘গুস’ নামের একটি বারড আউল, ‘জ্যাজ’ নামের এক আমেরিকান কাক, ‘বাটারকাপ’ নামের একটি ব্ল্যাক ভালচার ইত্যাদি ।
খাঁচায় জন্ম নেওয়া পুরুষ জেব্রা ফিঞ্চ প্রজননকালে সেই প্রজাতির নারীর সাথে সঙ্গম করতে ইচ্ছুক হয় যারা তার বড়ো হয়ে ওঠার সময় পাশে ছিল। শুধু পাখি নয় অন্যান্য কিছু প্রজাতির মধ্যেও দেখা যায়, জন্মের সময় যদি মানুষ কোনোভাবে উপস্থিত থাকে তাহলে পরবর্তীকালে সেই প্রজাতির মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ।
শুধুমাত্র মানুষ বা অন্যান্য প্রজাতির জন্যই যে পাখির এই ভিস্যুয়াল ইমপ্রিন্টিং হয় তা নয়, অনেকসময় কোন জড় বস্তুর সাথেও পাখির শাবকের এই ভিস্যুয়াল ইমপ্রিন্টিং হতে পারে। কনরাড লরেঞ্জের একটি ছবিতে দেখা যায় অনেকগুলি গ্রে ল্যাগ গিজ তাকে অনুসরণ করছে, এবার গল্পটা হলো বৈজ্ঞানিক সাহেবের বুটজুতোর সাথে ইমপ্রিন্টেড হয়ে বসে ছিলেন ওনারা। যৌনতায় অনেকসময় ‘ফেটিশ’ বলে একটি শব্দের কথা শোনা যায়। কোনো জড় বস্তু, বা পোশাক বা দেহাঙ্গের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণকে ফেটিশ বলে, পাখিদের ক্ষেত্রে এই ফেটিশ জড় বস্তুর সাথে ইমপ্রিন্টিং -এর ফল।
বর্তমান গবেষণা বলছে ওই ক্রিটিকাল পিরিয়ড বলে কিছু নেই। শাবক অবস্থায় অতিরিক্ত মানুষের বা অন্যান্য প্রজাতির সংস্পর্শ, পাখিকে মানসিক ভাবে অস্তিত্বসংকটে ফেলতে পারে, সেটা জন্মের ষোলো ঘন্টা পরেও যে কোনো সময়ে হতে পারে।
আজকাল খাঁচায় জন্ম নেওয়া শিশু পাখিকে জন্মের সময় বা পরে যথাসম্ভব মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। যদি নিতান্ত প্রয়োজন পরে তাহলে মাথা মুখ হাত ইত্যাদি ঢেকে শাবকের কাছে যাবার ব্যবস্থা হয়।
মাথা বনবন করছে? ভাবছেন খামোকা পাখিদের মনস্তত্ব নিয়ে পড়লাম কেন?
একটা একেবারে মজার জিনিস বলি, হয়তো কমবেশি সকলেই সত্যজিৎ রায়ের ‘বৃহচ্চঞ্চু’ নামের ছোটোগল্পটি পড়েছেন। দণ্ডকারণ্যে তুলসীবাবু বৃহচ্চঞ্চুকে ডিম ফুটে বেরোতে দেখলেন। বিশাল অদ্ভুতদর্শন সে পাখি, জন্মেই তুলসীবাবুকে দেখে তার পিছু নিলো। পরে দেখা গেলো, সে পাখি কারুর কথা শোনেনা, কারুর হাতে খায়না। তুলসীবাবু যখন আবার সে পাখি জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এলেন বা পরে দেখা করতে গেলেন, পাখির একনিষ্ঠ ব্যবহার, শুধুই আনুগত্য কিনা ভেবে দেখুন…
ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার। এক সদ্য ডানাগজানো ফিঙেশিশু ডালে বসে আছে আর কিউ কিউ করে ডাকছে, ডাকলেই তার মা এসে প্রজাপতি, পোকা, ফড়িং যা পাচ্ছে ধরছে আর বাচ্চার মুখের ভিতর খাবার দিয়ে যাচ্ছে, ঘটনাটা এতটাই ত্বরিৎগতিতে হচ্ছে যে ছবি তোলা যাচ্ছেনা। ভাবলাম আবার তো আসবে, নেক্সট বার এলে ছবি তুলবো। বাচ্চা আবার একটু পরে কিউ কিউ করে মা কে ডাকাডাকি শুরু করলো, ক্যামেরা রেডি করে ফোকাস টোকাস করে বসেছি, এবার আর মিস হবে না। ওমা! ফিঙে মা এসে বাচ্চাকে প্রচন্ড কর্কশ গলায় ধমকাতে শুরু করলো, চোখ মুখ রাগী, গলা বাজখাই। বাচ্চাটি করুণ মুখ করে মা কে দেখছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য ফিঙে পাখি খুব এগ্রেসিভ ধরণের হয়। অনেকসময় বড়ো শিকারী পাখিকেও তাড়া করে এলাকাছাড়া করে। হয়তো ছোটবেলার পিতামাতার এগ্রেসিভ ব্যবহার ইমপ্রিন্টিংয়ের এটি ফল।
Bhalo anek kichu janlam sikhlam somriddho holam
Thank you