অনেএএএক দিন আগে, একবার এক দেশে দুই বাল্যবন্ধু প্ল্যান করেছিলেন গলা জড়াজড়ি করে কোথাও ঘুরতে যাবেন।যেমন ভাবা, তেমনি কাজ তো আর দুম করে হয়না। অনেক প্ল্যান করে,ছুটির হিসেব করে, বাচ্চার স্কুলের এডমিশনের ডেট দেখে, হোটেল এর খোঁজ খবর নিয়ে, ট্রেন এর গতিবেগ এর পরিমাপ করে ঠিক হলো যাওয়া হবে কুমায়ুন। অক্টোবরের শেষের দিকে কোনো এক ভর দুপুরে তল্পিতল্পা বেঁধে দুই বন্ধুবর স্বামী, তাদের দুই স্ত্রী ও শিশুপুত্র নিয়ে চেপে বসলেন ট্রেনে। গন্তব্য বেরিলি। বেরিলি থেকে সোজা যাওয়া হবে শীতলাখেত।
NorthEastTravels – এর দীপঙ্কর দাদা আগে থেকেই তাঁর পরিচিত একটি গাড়ি স্টেশনে বলে রেখেছিলেন।সদা হাস্যমুখ ড্রাইভার সাহেব তার ট্রাভেরা টি নিয়ে আগেই পৌঁছে গেছিলেন স্টেশনে। প্রতিটি রাস্তার মোড়, পাহাড়ি বাঁক, বন্য পাখসাট, পাইনের ঋজু অহংকার লোভী ক্ষুধার্থের মতন সামনের আসন থেকে চেটে পুটে আত্মস্থ করবো , সেই লোভে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম। কোলে শিশুপুত্র ঘুমিয়ে কাদা। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম জানলার কাঁচ তুলে দিয়ে পেছনের সিটে দলের বাকিরাও স্বপ্নের দেশে। গাড়ি চলেছিল প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা। আমি চোখ মেলে অন্ধকার পাহাড় দেখছি, ঝিমঝিমে ধোঁয়া ধোঁয়া পাইন বন, জোনাকির মতন জনপদ দেখছি। জানলার কাঁচ নামানো। হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমায়। কতদিন পরে এই পাহাড়ি ঠান্ডা হাওয়ার আশ্লেষ! এ কি অস্বীকার করা যায়? আমি আইসক্রীম খেয়ে বিস্বাদ বিস্কুটের তৈরি কোণ টা ফেলিনা। আমার যে সবটা চাই…
শীতলাখেত
শীতলাখেত এ ঢুকতে ঢুকতে রাত ১০ টা বাজলো। KMVN বুক করা ছিল। হোটেলে ঢোকার কিছু আগে গাড়িতে বসে বকবক করে নিজেদের মন্দভাগ্য কে দোষারোপ করছিলাম। এত রাতে এলাম। লেপার্ড দেখতে পেলাম না। কখনো দেখিনি। কপাল ই খারাপ ইত্যাদি। পাহাড়ি মোড় ঘুরতেই কতগুলো গরু। মনটা আবার হায় হায় করে উঠলো। ড্রাইভার সাহেব কে কপট রাগের সাথে বললাম ‘ক্যায়া ভাইসাব, জঙ্গলি, হিংস্র, ম্যান-ইটার গাই দিখা দিয়া! কেয়া কপাল হ্যায় হামারা! পুরা সোনাবাঁধানো কপাল। ইতনি রাত মে ভি গাই বৈঠকার জাবর কাটতা !’ ড্রাইভার সবে তার হো হো হাসিটি থামিয়েছেন, পাহাড়ি মোড় ঘুরেই সামনে বিশাল চেহারার এক লেপার্ড। ‘আরে এতো আসল!!’ পেছনের সিটের সবাই লাফিয়ে উঠলো। গাড়ি একটু কাছে যেতেই তিনি অদৃশ্য হলেন। আমরা ও সবাই হেভি খুশি। হোটেলে ঢুকে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা, চিকেন খেয়ে কাঠের মেঝে, ফায়ার প্লেস অলা ইংরেজ আমলের ঘরগুলোর ভিতর পুরু লেপের তলায় অদৃশ্য হতে সবার বেশি সময় লাগলো না। আমি যদিও রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম কিছুক্ষণ। অত ঝকঝকে সুন্দর তারাভরা আকাশ আমার মনে গাঁথা হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।
পরদিন ভোরবেলা পাখি দেখতে বেরোনোর প্ল্যান। সূর্যোদয়ের আগেই হোটেল ঘরের সামনেই ঝাঁকে ঝাঁকে white throated laughingthrush, Himalayan bulbul, red billed blue magpie, Streaked laughingthrush, Himalayan barbet er পিকনিক শুরু হয়ে গেল।
পায়ের সামনে দিয়ে kalij Pheasant পালিয়ে গেল দ্রুত। আমার তো যাকে বলে এসব দেখে আনন্দে পুরো নালে ঝোলে অবস্থা আর কি! সমস্ত শীতলাখেত জুড়ে অসংখ্য জানা অজানা পাখি। ঘন নির্জন বনপথ ধরে এগোতে এগোতে মন যেন হঠাৎ দার্শনিক হয়ে যায়। এই নিস্তব্ধ ‘সবুজ অন্ধকারে’ গাছের পাতার ফাঁকে রোদের এক্কা দোক্কা খেলা….কি গভীর সুরে ডাকছে blue whisliting thrush!! আসার আগে Youtube এ শুনে কত এর ডাক মুখস্থ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এমন ভাবে এ ডাক আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। মনে হলো থাক, আর চাপ নিয়ে ওর ছবি তুলবোনা, এই কুয়াশা মাখা মাখন মাখন ভোরে ঘন বনপথে চুপ করে বসে ওর গান শুনি। মনের মধ্যে জয় গোস্বামীর ‘প্রেমিক’ বলে উঠলেন
“আমাকে তুমি উদ্ভিদ ভরা যে বইটা দিয়েছিলে
আজ সেখানে এক পা ও এগোনো যাচ্ছেনা, এত জঙ্গল।
গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে মাটিতে আলো আসতে দিচ্ছে না।”
সংসারে থেকে সন্ন্যাস ধর্ম হয়না। বেলা বাড়তেই জয় গোস্বামী তড়িঘড়ি পালালেন। আমিও বাচ্চার ম্যাগি বানিয়ে তাকে খাইয়ে, স্নান করিয়ে, নিজেরা রেডি হয়ে একটু বেলায় বেরোলাম সিয়াহি দেবী মন্দির ট্রেক।
প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ঘন বনপথ ধরে ওঠা ও ততোধিক সুন্দর গহীন বনপথে নামা… জাস্ট অসাধারণ। বনভূমি এক এক দিকে এক এক রকম চরিত্র। কখনো ঋজু সরলবর্গীয় আবার কখনো বা সবুজ শ্যাওলা মাখা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি।
গাইড দেখালেন নরম মাটিতে বুনো শুয়োর, লেপার্ড এর টাটকা পায়ের ছাপ। গা ছমছমে সেই পথ। মন্দির বাহুল্যবর্জিত। চারপাশের নিসর্গ দৃশ্য ও সেই অসম্ভব সুন্দর পথটির জন্যই বার বার যাওয়া যেতে পারে এই মন্দিরে। পরদিন সকালে আমরা এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে রওনা দেব কৌশানি।
কৌশানি
শীতলাখেত থেকে যখন ফাইনালি গাড়ি ছাড়া হলো, তখন KMVN এর বাইরে দুই তিনটি গাছ মিলিয়ে, এক ঝাঁক white throated laughingthrush, চূড়ান্ত হুটোপুটি করছে মনের আনন্দে। সবাই লাগেজ তুলছে গাড়িতে, আর আমি ভাবছি আবার কবে আসবো এখানে। আমি ঐ পাখির দলটিকে খুব তাড়াতাড়ি আবার আসার কথা দিয়ে ফেললাম তক্ষুনি। যদি কোনো জায়গা থেকে সদ্য ফিরে আবার যেতে ইচ্ছে হয়, সেটাই হলো সেই জায়গার সার্থকতা।
শীতলাখেত থেকে কৌশানী যাবার পথটি ভারী সুন্দর। পাহাড়ের ঢাল গুলিতে ঘন ঋজু পাইনের সবুজ হাতছানি। মাইলের পর মাইল গাড়ি ছুটছে নির্জন পাহাড়ী পথ ধরে। দুদিন আগে শীতলাখেত ঢোকার দিন রাত হয়ে গেছিল বলে, এই ঝলমলে রোদ্দুর মাখা পার্বত্য জঙ্গলের রূপ এভাবে চোখে পড়েনি। ড্রাইভার সাহেবের গাড়ি চালাবার হাতটি চমৎকার। খুব সরু বা এবড়োখেবড়ো রাস্তাও পেরোচ্ছিলাম ঝাঁকুনি বিহীন আরামে। পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে চাষ করা হয়েছে।
দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন বিভিন্ন আলাদা আলাদা সবুজের শেড দিয়ে নির্মিত এক ভাস্কর্য্য। ছোট্ট দোচালা বাড়ি তার কেন্দ্রে। শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে ঘরে ফিরছেন গ্রাম্য রমণী। ছবিগুলো দেখতে দেখতে যেন ওর মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে যাই। গন্তব্যের চেয়েও এই পথটুকু যেন অধিক আকর্ষণীয়। কৌশানী পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। হোটেলে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে চললাম নিকটবর্তী সরলা বেন মিউজিয়াম ও ঘন জঙ্গলাকীর্ণ শিব মন্দির দর্শন করতে। কৌশানী তে এই জায়গাটি আমার খুব ভালো লেগেছে। নির্জন বনপথ ধরে, অনেকটা হেঁটে পৌঁছালাম জনমানবহীন মন্দিরটিতে। প্রকৃতির মাঝে, ছোট্ট আড়ম্বরহীন মন্দিরটি সহজেই মনকে আকৃষ্ট করে।
কৌশানিতে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় হিমালয়ের নামজাদা তুষারশৃঙ্গ গুলি খুব সুন্দর দেখা যায় শুনেছিলাম কিন্তু আমরা পেলাম কুয়াশাময় দিগন্ত।
রাতে তারাভরা ঝকঝকে আকাশ ও চকচকে চাঁদ সেই অতৃপ্তি অনেকটাই ভরিয়ে দিলো। সন্ধ্যের পর পাহাড়ে করার কিছু নেই। আমরা হাঁটতে বেরোলাম। গা ছমছমে অন্ধকার পথ। হেঁটে মার্কেট অব্দি গেলাম। গুটিকয়েক মাত্র দোকান নিয়ে ছোট্ট মার্কেট। কিছু দোকান আছে, যেখানে মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখলে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহচর্যে সহজেই চিনে নেওয়া যায় কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ।
কর্তা অত্যন্ত খুশি হয়ে, হাতে চাঁদ পেয়েছি, মুখ করে ওখানে ঢুকে গেলেন। এক ঘন্টার শো। আমারও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বাচ্চার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর রুটিনের দাস আমি। এদিক ওদিক যথেচ্ছ সময় বিতরণ করতে পারিনা। তাকে কোলে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন নিকটবর্তী চা গাছের বাগান আর শালের ফ্যাক্টরী দেখে গাড়ি ছুটলো চৌকোরির দিকে।
চৌকোরি
কৌশানি থেকে চৌকোরি যেতে পথে দেখে নিলাম বৈজনাথ ও বাগেশ্বর মন্দির।দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরী এই মন্দিরগুচ্ছ আপাতঃ সরল কাঠামোর।
বৈজনাথের পাশেই স্বচ্ছতোয়া গোমতী নদী । ঝকঝকে রোদ্দুর পড়ে ঝিলমিলে জল । হাঁ করে দেখতে দেখতে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, কোলে ঘুমন্ত শিশু । সিঁড়ি গুলোর ধার গুলো বেশ মসৃণ । আচমকা আমার ওপর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব বেড়ে গেলো….তারপর একটু বাদে ধুলো ঝেড়ে উঠে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেলাম মন্দির চত্ত্বরে ।সংলগ্ন পুকুরটিতে অজস্র মাছ খেলা করছে । দশ টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতে দিয়ে দেখা যায় মীনদেহের আলোরণে সৃষ্ট জলের ঘূর্ণি যেন ক্যালাইডোস্কোপ । ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে শেপ ।
ছিমছাম মন্দিরটিতে প্রানপনে জোরালো নমস্কার করে ফিরছি, ভিতরে চিরকালের সংশয়াকুল মনটি প্রশ্ন করে উঠলো – ‘কে বেশি নাস্তিক, তোমার বাইরেটা না ভিতরটা?’ উত্তর নেই । আসলে চোখ চলে যায় বারবার আশেপাশের গাছ গুলিতে । ঘন্টাধ্বনি ছাপিয়ে শোনার চেষ্টা করি কলকাকলি । তাই স্বাভাবিক নিয়মে এ প্রশ্নের অবতারণা । উত্তর কি হবে ভাবতে ভাবতেই বাগেশ্বর মন্দির এসে পড়লো । গাড়ি দাঁড়িয়েছিল বাজারের বাইরে । মেন মার্কেটের ভিতরে হেঁটে গিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয় । এই অঞ্চলটি অপেক্ষাকৃত গরম । সবাই শীতপোশাক খুলে রোদচশমা পরে নিলো । মন্দিরের অধিক বিবরণ দেব না, তবে সরযূ আর গোমতীর সঙ্গমস্থলটি ভারী চমৎকার ।
দুই অপরিচিত দুদিক থেকে এলো আর মোড় ঘুরতেই তাদের আচমকা দেখা হয়ে গেলো । দুটি ভিন্ন রঙের স্রোত হাত ধরাধরি করে ছোট বড়ো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, ঘাসের বুক ছুঁয়ে, আকাশের নীল মেখে চললো জীবনের পথে । তীব্র ব্যাকুল দৃষ্টিতে চেয়ে আছি নদীদুটির আসা যাওয়ার পথের দিকে । শক্তিবাবু কে মনে পড়লো –
“মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।”
মন্দির আর নদীসঙ্গম দেখে গাড়িতে উঠে বসলাম । তক্ষুনি সাথে উপযুক্ত লেন্স না থাকায় নদীর বুকে পাথুরে চড়ায় চড়ে বেড়ানো wagtail আর Plumbous redstart এর ছবি পেলাম না বলেএকটু আফসোস হলো ।
মূল চৌকোরি ঢোকার আগে বৃক্ষবহুল অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এক রাস্তা ধরলাম । আমাদের হোমস্টে টি এখানে বুক করা হয়েছে আগে থেকে । সবে নতুন তৈরী হচ্ছে । পুরোটা নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়নি । ঘর সংলগ্ন বাগানে পেল্লায় সাইজের গন্ধলেবু, কুমড়ো, শশা ইত্যাদি সবজির গাছ । কিন্তু খুব ভালো করে কিছু দেখা হল না । আকাশের মুখ ভার ছিলই আগে থেকে । এখন শুরু হলো বৃষ্টি । সারা রাত চললো সে অঝোর বর্ষণ । পাহাড়ি জোলো ঠান্ডা হাওয়া শীতপোশাক ভেদ করে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো । কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে ডিনার করলাম । বেসিনের কনকনে জলে হাত ধুয়ে মনে হলো, এর চেয়ে চিকেন খাওয়া এঁটো হাত মাথায় মুছে ফেললে ভালো হতো । “আজ বারিশ হো রাহী হ্যায় ,মতলব কাল পিকস দিখনে কে চান্স হ্যায়” – হোমস্টে টির মালিক ভদ্রলোকের অমায়িক হাসি আর আশ্বাসবাণী শুনে আশান্বিত হয়ে দুখানা কম্বলের ভিতরে অন্তর্হিত হলাম ।
পরদিন ভালো করে আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়লাম । বৃষ্টির জল জমে আবার পিছল পাথুরে সিঁড়ি । ধুতি, আঁচল, কাছা কোঁচা, মাঙ্কিটুপি, ক্যামেরা, লেন্স সামলে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব অস্বীকার করে, black headed jay, bar throated siva ও আরো কিছু tit, warbler পাওয়া গেলো । এখনো মেঘ, কুয়াশা পুরোপুরি ক্লিয়ার হলো না । কিন্তু হিমালয়ের নামজাদা শৃঙ্গগুলির একটি অংশ দৃশ্যমান হলো । উত্তুঙ্গ শিখরে প্রথম সূর্য্যের আলোর আদর মাখা সেই দৃশ্য চিরকাল আমার মনে থেকে যাবে । হাত আপনা থেকেই কপালে চলে গেলো, প্রণাম করে ফেললাম সেই পবিত্র বিশালত্ত্ব কে । বৈজনাথ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্ন এসেছিলো মনে, আজ প্রকৃতি নিজে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো । ধন্য হলাম ।
গাড়ি ক্রমাগতঃ হর্ন দিচ্ছে । আজ যাবো মুন্সিয়ারি । তখনো জানি না যে, আমার মতে পুরো কুমায়ন ট্যুরের সবচেয়ে সুন্দরতম পথটি পাড়ি দিতে চলেছি । তখনো জানি না যে গন্তব্ব্যের চেয়েও আকর্ষণীয় এই পথটুকু আমার সমস্ত চেতনা কে অধিকার করে ফেলবে তার অমোঘ মায়াজালে ।
মুন্সিয়ারি
চৌকোরি থেকে মুন্সিয়ারির দূরত্ত্ব প্রায় ৯৭ কি.মি । আমরা সকালে যখন রওনা দিলাম আকাশ তখন পুরোপুরি মেঘমুক্ত নয় । পুরো রাস্তা জুড়েই চললো মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা । কিছুসময় পরে পথের পাশে পেলাম ঝকঝকে রামগঙ্গা নদী । জলের মতন স্বচ্ছ, সূর্য্যরশ্মির মতন হীরকখচিত নীল শাড়ি তার পরনে । অনেকক্ষন থেকে সবাই ড্রাইভার কে অনুরোধ করতে লাগলো ‘প্লিজ একটু দাঁড় করান কোথাও! ছবি তুলবো । ‘ ড্রাইভার বললেন সামনে একটা ভালো জায়গা আছে । সত্যি যে জায়গায় গাড়ি থামালেন, সেটা যেন সমস্ত রাস্তার মধ্যে বেস্ট । নদীর ওপাশে ঘন সবুজ রহস্যময় পাহাড়, যেন জুরাসিক ওয়ার্ল্ড এর সিনেমার লোকেশান ।
সকলে নদীতে নামলাম । জলের ঝরঝরে শব্দে এক মুহূর্তে সব পথের ক্লান্তি ভ্যানিশ । কিছু নাম না জানা ডানাঅলা পরীর দেখা পেলাম আশেপাশে । ছবি তোলাতুলি করে নদীর পাশ থেকে পছন্দমতন একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম । কোথাও গেলে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আসি বাড়িতে, সেটাই হয়ে যায় আমার সেরা উপহার । আমার বাড়ির টেবিলে আছে একটা আস্ত মুসৌরি, একোয়ারিয়ামে আছে একটা বিশাল বোরাগুহা, ড্রেসিং টেবিলে বদ্রীনাথ আর এখন ঘরে থাকবে একটা সম্পূর্ণ নদী ।
কিচ্ছুক্ষন পর থেকে রাস্তা মসৃণতা হারিয়ে ক্রমশ এবড়োখেবড়ো হতে শুরু করলো । বিরথি ঝর্ণার আগে একটা দোকানে লোকাল ট্রাউট মাছ সহযোগে দুপুরের আহার সম্পূর্ণ হলো । মাঝে নদী আর দুপাশে স্তরে স্তরে সাজানো পর্বতশ্রেণী । ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে । ছবিও তুলছি । বিরথি এক কথায় দারুন ।
সূর্য্যের আলোয় দুধসাদা ঝকঝকে তার তন্বীদেহের উচ্ছলতা । আশেপাশের প্রকৃতি ও খুব সুন্দর । উঁচু পাহাড়ের গায়ে স্থানীয় মহিলারা গবাদি পশুর খাদ্য ঘাস কাটতে উঠেছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে । ভয় লাগে দেখতে । ছবি তোলা আর চারপাশ দেখতে দেখতে কখন আবার আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে । ড্রাইভার তাড়া দিলেন – ‘মৌসম খারাব হো রাহি হ্যায় । জলদি চলিয়ে ‘ । এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল । মৌসম এর সাথে সাথে আমার খারাপ মাথা যে আরো খারাপ হয়ে যাবে বুঝিনি ।
ছোটবেলায় জলরঙে ছবি এঁকে স্কুলে একটু পরিচিতি পেয়েছিলাম । সারা স্কুল এক ডাকে চিনতো । ভালো ছবি অনেকেই আঁকে । কিন্তু আমি মাস্টারমশাই এর থেকে একটা জিনিস রপ্ত করেছিলাম । সবাই যখন পেন্সিল দিয়ে গ্রামের দৃশ্য এঁকে, ধীরে ধীরে রং ঘষে সেই ছবি কে পূর্ন্যতা দিচ্ছে,আমি তখন সাদা পাতাখানা ভিজিয়ে আনতাম জলে । তারপর তাতে উপুড় করে ঢেলে দিতাম আকাশি নীল, সবুজ, হলুদ, বাদামি রং ।
ভেজা পাতায় জলরং আপন খেয়ালে মাখামাখি হয়ে নিজস্ব কিছু টেক্সচার নিতো । নিজেই হয়ে যেত সোনালী ধানক্ষেত, নীলাকাশ কিংবা বাদামি পাহাড় । একই টেক্সচার, দ্বিতীয় বার করা যেতোনা, কারণ জিনিসটি স্বতঃস্ফূর্ত । স্কুলে ম্যাডামদের আর সহপাঠীদের অবাক দৃষ্টি আমাকে ভিতরে ভিতরে গর্বিত করে তুলতো । আজ প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসে, ঈশ্বর কে তাঁর আপন তুলিতে সেই একই পদ্ধতিতে জলরঙে ছবি আঁকতে দেখে আমার মাথা নত হয়ে গেলো । আচমকা উড়ে আসা মেঘ সম্পূর্ণ পথের সৌন্দর্য্য বহুগুন বাড়িয়ে দিলো । আমি আঁকতে পারি বলে শৈশব থেকে যে সুপ্ত অহংকার লালন করেছি মনে মনে, আজ এক লহমায় তার সমস্তটা মিথ্যে হয়ে গেলো । কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা । সহযাত্রীদের আর ড্রাইভার কে বিরক্ত করে গাড়ি থামিয়ে কিছু ছবি তুললাম । ‘বৃষ্টি এসে পড়ছে, দেরি করো না’ । কানে ঢোকাতে পারছিনা, এইসব সাবধানবাণী । কাউকে বোঝাতে পারছিনা আমার কেন এতো অবাক লাগছে । গন্তব্ব্যের চেয়েও এই পথ কেন এতো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে আমার কাছে । মনে হচ্ছে আমার ব্যাটারি খুলে গেছে । চড় থাপ্পড় মেরে নিজের রিমোট টাকে ঠিক করতে চাইছি, হচ্ছেনা । চ্যানেল পাচ্ছিনা ধরতে, টিভির পর্দায় কেবল সাদা কালো ঝিরঝির । কিচ্ছুক্ষন পরে শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ।
যখন মুন্সিয়ারিতে এসে হোটেলে ঢুকলাম, তখন ও মেঘ কাটেনি, কিছুটা নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে । হিমেল হাওয়ায় প্রচন্ড কাঁপুনি । সূর্য্যাস্ত দেখা হলো না, এতো মেঘ! কিছুসময় পর মেঘের ঘন স্তর ভেদ করে সিঙ্গারার মতন সোনালী একটি ত্রিভুজ উঁকি দিলো । পঞ্চচুল্লির একটি শৃঙ্গ যেন কিচ্ছুক্ষণের জন্য কোনোমতে মুখখানি বার করে আবার তড়িঘড়ি মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হলেন ।
পাহাড়ে সন্ধেবেলাই যেন মনে হয় ঘোর রাত । চোখের সামনে ধোঁয়া ওঠা সিঙ্গারার মাথাটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই বুঝলাম আর ঘন্টাখানেক পর থেকেই ডিনারের তাগাদা শুরু হবে । পাহাড়ের গায়ে ঘরগুলিতে আলো জ্বলে উঠলো জোনাকির মতন ঝলমলে । সদ্য বৃষ্টি হয়ে গেছে । মুন্সিয়ারির বাতাস কনকনে ঠান্ডা । বিছানা, চেয়ার সব মনে হচ্ছে জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে ।আমার একটাই সোয়েটার । জুল জুল করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘তোর নাম হলো আজ থেকে নীলমনি, এতদিনের ধকলে তুই পরিশ্রান্ত । তোর একটা দুটো বোতাম সুতোর বন্ধন ছেড়ে পালাতে চাইছে, তুই যেন কোনোমতেই এই বাজারে আর আমার সাথে এই বিট্রে টুকু করিস না । লাগেজের ভয়ে তোর ভাই বোন গুলো কে কলকাতায় ফেলে এসেছি, বলে তুই আবার এই দুর্দিনে সব বোতাম খসিয়ে, উল ছিঁড়ে কেলেঙ্কারি করিস না বাবা! ‘
রাতে আবার নিচের ডাইনিং রুমে খেতে যেতে হলো । পাহাড় থেকে চরম ঠান্ডা হাওয়া এসে আমার নীলমনি কে কড়া চোখ দেখাচ্ছে । নীলমনি ও বেজায় ভীতু, খোলা ব্যালকনিতে আর নিজের মহিমা দেখতে পারছে না কিছুতেই । তার ই মধ্যে একটিবারের জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম । ‘বাহ্..আকাশ তো পরিষ্কার হয়ে গেছে । ওই তো বুটিদার কালো শাড়ি পরে অভিসারিকা আকাশ, পাহাড়ের উন্নত আয়ত গভীরতার দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে । ‘ পাহাড়ের মুখ দেখা যাচ্ছেনা, আকাশে চাঁদের আলো খুব জোরালো তো নয়, তবু কল্পনা করে নিলাম, সে ও আকাশের আশ্লেষে আপ্লুত ।
‘আঃ ঠান’দি! ঘরে ঢুকে কাব্য করো, নট হিয়ার প্লিজ’ – নীলমনি কঁকিয়ে উঠলো ।
ধোঁয়াওঠা খিচুড়ি, ওমলেট, আলুভাজা দিয়ে ডিনার সেরে ঘরে ঢুকে ঘড়িতে দেখলাম ৯ বাজে । কলকাতায় এই সময় আমি বিকেলের চা খাই, কোনো কোনোদিন অফিস থেকে ফেরাও হয় না, কোনোদিন আবার বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে বেরোই আর এখন আমি সম্পূর্ণ রেডি ঘুমিয়ে পড়ার জন্য । এতো ঠান্ডা লাগছিলো,যে ঘুমিয়ে পড়াটাই শ্রেয় মনে হলো । পরদিন সকালে আমাদের পাখি খুঁজতে বেরোনোর কথা ।
পরদিন ঘুম যখন ভাঙলো তখন বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার । চটপট তৈরী হয়ে বেরোলাম । নীলমনি সারারাত আমার সাথেই ছিল । তবে রাতের চেয়ে সকালটা তবু ভালো, তবু যেন জোলো হওয়ার দাপট টা কিছু কম মনে হচ্ছে । ঘরের সামনে আলো আঁধারি মেখে পঞ্চচুল্লি সবে আড়মোড়া ভাঙছে ।
কাল এর দেখা পাইনি, আজ সম্পূর্ণ টা দেখতে পেয়ে মন ভরে গেলো । সূর্য্য উঠবে, আস্তে আস্তে হলুদ লালচে হচ্ছে পঞ্চচুল্লির মাথা । ড্রাইভার সাহেব তাড়া দিলেন পথে দেখে নিতে, বেরোতে দেরি হলে পাখি মিস হবে । ঘুমন্ত শিশুকে চাদরে মুড়িয়ে পোটলার মতন করে ক্যামেরা কাঁধে আমরা স্বামী স্ত্রী আর আমাদের সাথে আরো যে পরিবারটি ছিল,তার গিন্নি এই তিনজনে মিলে বেরোলাম বিটুলিধারে ।
গাড়ি দাঁড়ালো যখন তখন মনে অনেক আশা সকাল সকাল এসে পৌঁছেছি, নিশ্চই দারুন কোন এক্সপেরিএন্স হবে । কলকাতা থেকে শুনে গেছিলাম এখানে মোনাল, চিয়ার ইত্যাদিদের দেখা পাবার কথা । শিশুকে তার বাবার কাছে দিয়ে আমি আর আমার সাথে মেয়েটি ড্রাইভারের সাথে নামলাম পাহাড়ের গা বেয়ে, গলায় ঝোলানো ওজনদার লেন্স সমেত ভারী ক্যামেরা ।
প্রথমে একেবারেই আমার ইচ্ছে ছিলোনা ওভাবে নামার কিন্তু ড্রাইভার বললেন, ওপরে থাকলে কিছু পাবেন না নামতে হবেই, পূর্বসূরিদের উদাহরণ দেখালেন, তবু আমি নিমরাজি -‘ওনারা স্পাইডারম্যান আর আমি হাঁদাভোঁদা । এই খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে যাবো সে হয়না । ‘ ‘আচ্ছা একটু নামুন!’ সেই কথা মতন দু পা নামলাম আর চোখের সামনে তিনটি চিয়ার ফেজেন্ট লম্বা ল্যাজ দুলিয়ে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলো । এক সেকেন্ডের মধ্যে মনের ভিতরে বনবাসে জর্জরিত জানকী আদুরে গলায় রামচন্দ্রের কাছে আবদার করে উঠলেন, ‘হ্যাঁগা তুমি আমাকে ওই সোনার হরিণ (পড়ুন: চিয়ার এর ছবি ) ধরে এনে দিতে পারো না?’ ব্যাস রামচন্দ্র অমনি কাছা কোঁচার নিকুচি করেছে বলে পাগলপারা হয়ে ছুটে চলে গেলেন । এক্ষেত্রে আমি ই রামবাবু,আমি ই সীতা ম্যাডাম । পিছন থেকে লক্ষণরূপী সঙ্গিনী বহুবার বললো – ‘আর কি নামবে? থাক চলো ফিরি । ‘ আমার কানে এসব ঢুকছে না । হুর হুর করে নামলাম অনেকটা নীচে,সাথে আমার সঙ্গিনী ও ড্রাইভার । দু একবার পা হড়কালাম, কিন্তু কিছু হলোনা । নীচে নেমে কিছু পেলাম না, তখন আরো নামার ইচ্ছে হলো….একসময় পাহাড় বিপজ্জনক ঢালে নিজের বিস্তার ঘটিয়েছে দেখে তখনকার মতন দাঁড়ালাম । এখান থেকে রাস্তা দেখা যাচ্ছে না । ওপর টা ঘন জঙ্গল, গাছ পাতার আড়ালে কোথায় আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে, কোথায় বা আমার শিশু, কোথায় বা তাকে কোলে নিয়ে তার পিতা….তাকেও তো পাখি দেখার সুযোগ করে দিতে হবে, আমরা যে দুজনেই সমান আগ্রহী । ড্রাইভার দাদা ও আমার সঙ্গিনীর হাতে ক্যামেরা দিয়ে ভাবলাম দৌঁড়ে ওপরে উঠে এসে তাকে পাঠাবো নীচে । একা ফিরতে লাগলাম ঢাল বেয়ে । কোনো সুস্পষ্ট পথ নেই, পাথর আঁকড়ে কোনো মতে চলেছি হামাগুড়ি দিয়ে । একটু তাড়াহুড়ো করে আসার চেষ্টায়, একসময় ভীষণ হাঁফ ধরে গেলো । বিশ্রী একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিলো আর দম নিতে পারছিনা । ওদিকে সামনে যে এগোবো সেই উপায় ও নেই, কারণ আমি পথ ভুল করে ফেলেছি । পাহাড়ের এই অংশটা একেবারেই খাড়াই । হাত বাড়িয়ে একটা ফার্ন গাছ ধরলাম, ওটাকে ধরে কোনো মতে যদি দেহটাকে এগোতে পারি সামনের দিকে । ফার্ন ছিঁড়ে চলে এলো হাতে, পা আলগা হয়ে গেলো, হাঁচোড় পাঁচর করে,একটা গাছের ডাল ধরে ফেললাম । হৃদপিন্ড যেন লাফাতে লাফাতে খাঁচার বাইরে বেরিয়ে আসবে! এতো মৃত্যুভয় কোথায় ছিল এতদিন! হাসি পেলো । হাসি তো পাবেই, ততক্ষনে যে গাছের ডাল টা ধরেছি, সেটাকেই পেঁচিয়ে ধরে, তার শেওলা সবুজ কাণ্ডে উঠে বসেছি । এখান থেকে পুরো বনভূমি দৃশ্যমান । নিস্তব্ধ জঙ্গলে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক যেন প্রতিমুহূর্তে রচনা করছে সংগীতের মূর্ছনা, তার মোহিনী আকর্ষণে মাকড়সার জালে পড়া পতঙ্গের মতন মনে হচ্ছে নিজেকে । এমন জায়গায় বসে আছি, যেখান থেকে নিজে নিজে উদ্ধার হবার কোনো চান্স নেই । কেউ যদি আর কোনোদিন আমার খোঁজ না করে, তাহলে সারাজীবন এখানেই বসে থাকতে হবে! দার্শনিক হয়ে গেলাম পুরো । নীলমনির একটা বোতাম এইসব ধস্তাধস্তিতে বিরক্ত হয়ে নাড়িভুড়ি সমেত উল্টে এসেছে ।
হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার নাম ধরে ডাকছে আমার সঙ্গিনী । তারা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির । আমি তো হাতে চাঁদ পেলাম । মুখে ভাব করলাম যেন, খুব কুল,কিছুই হয়নি, আমি এমনি গাছের ডালে আত্মগোপন করে বসে পাখি দেখছি । ওদের দেখে হাত এমন ভাবে নাড়লাম যেন, বিদেশসফর সেরে এয়ারপোর্ট এ নেমেছি সোনিয়া গান্ধী ।
ড্রাইভার দাদা স্পষ্টতঃই বিরক্ত – ‘আপ পের্ পে কিউঁ লাটকি হুয়ি হো?’
আমি : ‘পের্ পে ব্যাঠনে সে বার্ডস দিখনে কা চান্স জ্যাদা হায় । ‘
‘আপনে মেরে দিমাগ কা দহি বানা দিয়া, জলদি উতরো, হাত দো মুঝে । ‘
শোলের ঠাকুর সাহাবের মতন দাঁত কিড়মিড় করে বললাম ‘নেহিইইইই’
ওনার সাহায্য ছাড়া উদ্ধার হতাম না সেদিন কিছুতেই । কিন্তু কিছু কিছু কঞ্চি আছে,যারা ভাঙে তবু মচকায় না টাইপ…..তখন ও বিড়বিড় করে বলে চলেছি, ‘ইট ইস ওকে, আই ক্যান হ্যান্ডেল । আমি তো নিজেই চলে যেতাম, সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ,কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন ছিলোনা ‘ ইত্যাদি…
আসলে ঝুঁকি যে নিচ্ছি, তা বুঝিনি । বুঝে শুনে ভুল তো কেউ করেনা । অজ্ঞানবশতঃ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বা ভুলভ্রান্তি থেকেই তো আমরা শিক্ষা নেই । আমার সেদিন একটা বড়ো জিনিস শেখা হলো । ওপরে উঠে শিশুপুত্রের আনন্দ কণ্ঠস্বর ও তার উদ্বিগ্ন পিতার মুখটি দেখে আমিও নিশ্চিন্ত হলাম । এরপর আমি শিশুকে কোলে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম গাড়িতে । আর তার বাবা মাহেশ্বরী কুন্ড অব্দি হেঁটে উঠে গিয়ে দারুন প্রাকৃতিক সাহচর্য, প্রচুর পাখির দেখা পেলো । সেদিন বিকেলে নন্দা দেবীর মন্দির, পাংতে জির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা দেখতে গেলাম । পাহাড়ের গায়ে একজায়গায় বিশাল ডানা মেলে উড়ছে অনেকগুলি হিমালয়ান গ্রিফন ভালচার ।
খুব শখ ছিল রেড বিল্ড ও ইয়েলো বিল্ড ব্লু ম্যাগপাই দেখতে পাবো কুমায়ুনে…..সত্যি সবজায়গায় কাক, চড়াই এর মতন এর ঝলমলে রঙ্গীন উপস্থিতি মনকে খুশি খুশি করে তোলে, মেঘাছন্ন দিন ও মনে হয় যেন ঝকঝকে । আবার যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন আগের দিনের মতনই মেঘে ঢেকে গেছে পঞ্চচুল্লি, সূর্য্যাস্ত কপালে নেই ।
মুন্সিয়ারির দুটি দিন কেটে গেলো এইভাবে । কাল সকালে বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে সেই বিকেলে গিয়ে পৌঁছাবো ধৌলছিনা । এবার ফেরার পালা শুরু । মুন্সিয়ারি ছিল পুরো কুমায়ুন ট্যুরের সর্বোচ্চ্য লক্ষ্য, আজ বিকেল থেকেই তাই মনখারাপ সবার…
“পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল
আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি
এই আক্ষরিক সত্যের কছে যুক্তি মূর্ছা যায়।
শিহরিত নির্জনতার মধ্যে বুক টনটন করে ওঠে
হাল্কা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন
সবুজকে ধূসর হতে ডাকে….”
ধৌলছিনা
মুন্সিয়ারি থেকে ধৌলছিনা অব্দি নামতে সময় লাগলো প্রায় সাত ঘন্টা । ভোরবেলা বেরিয়ে একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে ধৌলছিনা আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যেবেলা হয়ে গেছে । পাহাড়ের ওপারে সূর্য্য ডুবছে দিগন্তে মায়াবী আলো ছড়াতে ছড়াতে । এই অপূর্ব মায়াবী সৌন্দর্য্য মন প্রানভরে দেখলাম ।
তারপর মন ভরিয়ে, চোখ জুড়িয়ে দিয়ে অন্ধকার নামলো । ধৌলছিনার মা আনন্দময়ী গেস্টহাউস টি ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সবরকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত । পরদিন সকালে গাইডের সাথে হেঁটে উঠলাম পাহাড়ের ওপরে মা আনন্দময়ী আশ্রম অব্দি । চারপাশে ডাকছে অজস্র পাখি, কিন্তু তুষার শৃঙ্গ মেঘের আড়ালে । মা আনন্দময়ী আশ্রমটি অসম্ভব শান্ত, পবিত্র । আশ্রম চত্বরে হলুদ ছোট্ট শরীরের গ্রে হুডেড ওয়ারবলার নাচানাচি করছে শাখায় শাখায় । নামার সময় পেলাম ট্রি ক্রিপার, উডপেকার, লাফিংথ্রাস ইত্যাদি । নেমে দেখলাম অপূর্ব ঝকঝকে রোদ উঠেছে । গেস্টহাউসের সামনের লনে সুন্দর সকালটি কাটিয়ে সেদিনই গেলাম বিনসর ।
বিনসর
বিনসর পাহাড়ের ওপর, জঙ্গলের মধ্যে । এর মূল আকর্ষণ হলো এর গা ছমছমে রোমাঞ্চকর পরিবেশ । এখানে আমাদের KMVN বুক ছিল আগে থেকেই । হোটেলের ঘরে জিনিসপত্র রেখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছালাম বিনসর ভিউ পয়েন্ট । দারুন সুন্দর এর পরিবেশ ।
সূর্য্য ডুবছে দিগন্তে আর নিচের জঙ্গলে কিচির মিচির করে শান্তিভঙ্গ করছে একদল ইউরেশিয়ান জে । এর জ্ঞাতি ভ্রাতা ব্ল্যাক হেডেড জে কে আমরা কুমায়ুনের বিভিন্ন্য জায়গায় পেয়েছি কিন্তু ওনাদের পেলাম এখানেই । ফেরার পথে ঘন হয়ে এসেছে অন্ধকার । কিছুদিন আগে নাকি এক লেপার্ড ম্যান ইটার হয়েছে । নিচের পাহাড়ি গাঁও থেকে তুলে নিয়ে গেছে এক প্রৌঢ়কে । গা ছমছমে পরিবেশ । নিজেরা একা হোটেলে ফিরতে ভয় করলো ।
ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করতে তিনি গাড়ি নিয়ে এলেন । বিনসরে আবার সন্ধ্যের পর থেকে জেনারেটরে আলো জ্বলে আর রাত নয়টার পর আলো থাকেনা । ঘরে ঘরে মোমদানির ওপরে মোটা মোটা মোমবাতি আর পাশে দেশলাই রাখা । সন্ধ্যেবেলা বিশাল ডাইনিং হলে গেলাম রাতের খাবারের জন্য খাবার শেষে অন্ধকার উন্মুক্ত ব্যালকনি ও প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে ঢুকলাম হোটেলের ঘরে । আলো নিভে গেলে করার কিছুই নেই, তার ওপর প্রচন্ড জঙ্গুলে ঠান্ডা কাঁপিয়ে দিচ্ছে মেরুদন্ড । রাত নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য হলাম ।
পরদিন সকালে উঠলাম । ইচ্ছে ব্যালকনির ওপর থেকে সারা আকাশ জোড়া কুমায়ুনের বিখ্যাত শৃঙ্গগুলো দেখি যার জন্য বিনসর বিখ্যাত । কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন্য ছিল না, মেঘ আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে । চারপাশে আরো কিছু ঘোরাঘুরি করে হোটেল থেকে চেক আউট করে গেলাম নৈনিতাল ।
নৈনিতাল
নৈনিতাল পাহাড়ের মাঝে টলটলে জলের লেক, অপূর্ব এর পরিবেশ প্রচুর নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে, রকমারি ছাতা, জুতো, দস্তানা, মজা, টুপি, খেলনা, সোয়েটারের পসরা বসেছে চারদিকে । রঙ্গীন মানুষজনের ভিড় । আমরা নৈনিতালে বোটিং করলাম, পরদিন নৈনিতালের আশেপাশের কিছু দ্রষ্টব্ব্য স্থান দেখলাম । পরদিন আমাদের ট্রেন লালকুঁয়া থেকে । কুমায়ুন কে বিদায় জানিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে । পাহাড়ের তরঙ্গায়িত ভালোবাসা টুকু শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেটুকু পাতিত জল পরে থাকে, তার মূল উপাদান হলো স্মৃতি । অজস্র পাখি, দারুন ল্যান্ডস্কেপ আর একরাশ প্রকৃতিপ্রেম বুকের নিয়ে ফিরে এলাম ।
Itinerary
Kumaon or Kumaun is one of the two regions and administrative divisions of Uttarakhand, a mountainous state of northern India, the other being Garhwal. It includes the districts of Almora, Bageshwar, Champawat, Nainital, Pithoragarh, and Udham Singh Nagar.
We have visited Kumaon region in 2017 for the first time. Our 12 days itinerary was as follows :
Day 1 : Train from Howrah
Day 2 : Reached Bareilly junction and were transferred to Shitlakhet hotel by car.
Day 3 : Morning birdwatching session and trek to Siyahi devi temple.
Day 4 : Checked out from Shitlakhet KMVN and checked in at Kausani. Sightseeing at Kausani.
Day 5 : Checked out from Kausani hotel and checked in at Chakouri homestay.
Day 6 : Checked out from Chakouri and reached at Munsiary.
Day 7 : Munsiary sightseeing.
Day 8 : Checked out from Munsiary and came down to Dhaulchina
Day 9 : From Dhaulchina, we were transferred to Binsar
Day 10 : After one night stay at Binsar, we went to Nainital
Day 11 : Nainital Sightseeing
Day 12 : From Nainital, we went to Lalkuan to get or train towards Howrah
0 comments on “Kumaon Tour”Add yours →