Malsej ghat Monsoon Trip

মনে করা যাক, একদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার । বিষন্ন গম্ভীর মেঘ পরতে পরতে জমেছে আকাশের গায়ে, তারপর শুরু হলো অবিশ্রান্ত বর্ষণ । আঁকার খাতা নিয়ে জানলার সামনে বসলাম, বৃষ্টির ছবি আঁকবো বলে । আগে সুন্দর একটা বাড়ি আঁকলাম, ছোট্ট কুঁড়েঘর টাইপ । তার পেছনে নদী, সামনে মাঠ ঘাট, বাড়ির পাশে একটা গাছ, গাছের পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা । চেনা গ্রামের সিনারি । এরপর আকাশে গোল গোল মেঘের দলা এঁকে কয়েকটা ছিট্ ছিট্ বৃষ্টির টেক্সচার দিয়ে দিলাম । রাস্তা দিয়ে একটি মানুষ যাচ্ছে, মাথা দেখা যাচ্ছেনা, কালো ছাতার তলায় কাঁধ অবধি ঢাকা । ব্যাস বর্ষার ছবি কমপ্লিট ।
বাড়ি, ঘর আর যা কিছু সব কিছুর ওপর বৃষ্টি পরে, এই দেখে এসেছি ছোটবেলা থেকে, আর এই এঁকেছি দিনের পর দিন ।
ভেবেছিলাম এই ধ্রব সত্য ।
ভুল ভাঙলো মালশেজঘাটে বর্ষায় দুটো দিন কাটিয়ে এসে…

Malsej ghat Monsoon Trip
Malsej Ghat Rain

মালশেজঘাটে বৃষ্টি এমন যেন, ঘর বাড়ি রাস্তা গাছ কোনো কিছুর ওপর বৃষ্টি পড়ে না । যেন বৃষ্টি আর মেঘ দিয়ে তৈরী আলাদা আস্ত একটা জগৎ । ঝিরিঝিরি ঝমঝম, গুঁড়িগুঁড়ি, তিরতিরে জলের ফোঁটা দিয়ে তৈরী সে পৃথিবী । আর যা কিছু জাগতিক, বাড়ি গাছ সব যেন তৈরী হয়েছে অনেক পরে, সেই মেঘ বৃষ্টির জগতে এক্সটার্নাল কম্পোনেন্ট হিসেবে ।

Map

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে পুনে ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে অবস্থিত ৭০০ মিটার উচ্চতার এই পার্বত্য অঞ্চলে পুনে থেকে যাবার ডিরেক্ট বাস আছে, কল্যাণ হয়ে ট্রেনে যাওয়া যায় । ঔরঙ্গাবাদ থেকে এক সকালে বেরিয়ে আহমেদনগর হয়ে ঘন্টা চারেক সময় লাগলো গাড়িতে । রাস্তায় পড়লো শিবাজী মহারাজের জন্মস্থান শিবনেরি দুর্গ ।

Beautiful Western Ghats

ঘন সবুজ পাহাড় যেন রেশমি কার্পেট মোড়া, এমন এক মিক্সড মিডিয়ার পেইন্টিং যেন আকাশটি জলরঙে আঁকা, আর পাহাড়গুলি যেন পেইন্টিং নাইফের চওড়া মোচড়ে বিভিন্ন বর্ণের সবুজের অদ্ভুত এক টেক্সটারইজেসন । দিগন্ত বিস্তৃত ক্লোরোফিলের সাম্রাজ্য । শিবনেরি পেরোবার কিছু পর থেকে রাস্তাঘাট ভিজে, জোলো হাওয়া, মেঘ মাখা পথঘাট ।

Cloudy Weather

গাড়ির কাঁচ তুলতে হলো, ঝিরঝিরে বৃষ্টিদানা ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার মাথার এলোমেলো পাখির বাসা । মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের একোমোডেশন আগে থেকে বুকিং করা ছিল । এবার এটা নিয়েও একটা মজার ঘটনা আছে । MTDC র হোটেলটি পাহাড়ের এমন অবস্থানে তৈরী যে সেখানে সবসময় মেঘ বৃষ্টি চলে ।

MTDC Resort

আমি আড়াই দিন মতন ছিলাম, ২৪ ঘন্টাই প্রচন্ড মেঘের মধ্যে । হোটেলটি খুব সুন্দর, আর ব্যালকনি থেকে সহ্যাদ্রি পর্বতমালা ঘেরা বিশাল টলটলে জলের পিম্পলগাঁও লেক দেখা যাবার কথা । কিন্তু দুই সেকেন্ডের জন্য মেঘ যদি সরে যায় তাহলে ঘরে খাট থেকে নেমে ব্যালকনি পৌঁছাতেই ঘূর্ণায়মান মেঘের মধ্যে শরীর ডুবে যায় ।

From MTDC Resort Balcony

বৃষ্টির স্পর্শ লেগে থাকে চোখে, গালে, চিবুকে, চুলে । সারাক্ষন শো শো করে হাওয়া চলছে, যেন পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার গভীর দুর্যোগময় রাত্রি এবং তার সাথে দুমদাম করে রিসোর্টের বিভিন্ন দরজার বন্ধ হবার শব্দ, সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা । MTDC র ভিতরে ফোনের কোনো টাওয়ার নেই । এই ফোনের টাওয়ার না থাকা বা প্রচন্ড হাওয়া আর মেঘের কারুকার্য শুধুমাত্র MTDC র ভিতরেই, হোটেল থেকে বেরোলে অবস্থা একটু আলাদা ।

Pimpalgaon Joga Dam in Malsej Ghat

মালশেজঘাটে আশেপাশে কিছু মন্দির আছে, সাইটসিইং করানোর জন্য আড়াই হাজার – তিন হাজার টাকায় গাড়ি পাওয়া যায় । আমরা ওগুলি যাইনি, আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পিম্পলগাঁও ড্যাম, যেটা মোটামুটি হোটেল থেকে ৫ কি.মি দূরত্বে । গাড়ি নিয়ে ড্যাম পর্যন্ত গেলাম ।

Pimpalgaon Joga Dam in Malsej Ghat

শীতকালে প্রচুর ফ্লেমিংগো আসে শুনেছি, কিছু রেসিডেন্ট হয়ে গেছে যারা সারা বছরই লেক বা লেকের কাছাকাছি অঞ্চলে থাকে এছাড়াও অন্যান্য কিছু পাখি বা অনাবিল দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত প্রকৃতির আকর্ষণে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ছাতা, রেনকোট পরে আমরা দুইজন দুটি ক্যামেরা ও শিশুপুত্র কে নিয়ে বেরোলাম ড্যামের উদ্দেশ্যে ।
মুম্বাই বা পুনে বা নিকটবর্তী বড়ো শহরগুলি থেকে প্রচুর অল্পবয়স্ক, স্বল্পপোশাকের ছেলে মেয়ের দল এসে ভিড় করে এখানে । উইকেন্ডে প্রচুর ভিড় তো থাকেই, সপ্তাহের বাকি দিনগুলিও এই আনন্দকামী মানুষগুলির হুল্লোড়ে মেতে থাকে হোটেলগুলি । এখানে এতো হাওয়া চলে সবসময়, যে ছাতা কোনো কাজেই লাগেনা আর সাধারণ যে শ্রেণীর টুরিস্ট দেখলাম এসেছেন, তাঁরা বৃষ্টি উপভোগ করতেই এসেছেন । সবাই প্রিয় মানুষটির হাত ধরে ভিজছেন, খুনসুটিতে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলা মুক্তো ছড়ানো হাসিতে গড়িয়ে পড়ছেন ট্যাটু করানো সবল বাইসেপের ঘেরাটোপে, সুন্দর মেইনটেন্ড করা ভেজা অলোকচূর্ণে লেগে থাকে দানা দানা বৃষ্টি, হোটেল সংলগ্ন ভেজা শ্যাওলা ধরা রাস্তায় তীক্ষ্ণ হাই হিল পরে হাঁটছেন । ভালোই লাগে দেখতে……যেন সিনেমা সিনেমা…
সব সিনেমাতেই একটু কমিক রিলিফের প্রয়োজন, হয়তো সিরিয়াস জীবনেও….অতো রোমান্টিক পরিবেশে সেই কমিক রিলিফটুকু ছিল বেশ ভালোই । পা থেকে মাথা অব্দি সাদা প্লাস্টিকের রেনকোট, গলায় ঝোলানো ক্যামেরা বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ঢুকিয়েছি রেনকোটের ভিতরে আর তাতে পেটের কাছটা বেঢপ উঁচু হয়ে আছে, যেন এক্সট্রা পাঁজর ফুটে উঠেছে দেহের বাইরে । হাতে ক্যামেরা মোছার জন্য একটা ন্যাতা,কাঁধে বাচ্চার জলের বোতল, আরেক হাতে বাচ্চার হাতের মুঠি ধরা শক্ত করে, আর নিজের কোলের কাছে ছোট একটা প্লাস্টিকের পুটলি তার মধ্যে বাচ্চার এক্সট্রা জামা কাপড়ের সেট, সর্দির ওষুধ, হনুমান টুপি, বাইনোকুলার, টিসু পেপার, বিস্কুটের প্যাকেট । শ্যাওলা ধরা রাস্তায় স্পাইক দেওয়া জুতো পরে হাঁটতে গিয়েও আছাড় খেলাম । তারপর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাবা তুলে গাল দিতে দিতে গাড়িতে গিয়ে বসলাম যখন, তখন রিসোর্টের অন্যান্য আনন্দকামী উৎসুক চোখগুলিতে মাঝরাস্তায় ET দেখতে পাবার আনন্দ উপচে পড়ছে ।

The lake

ড্যামের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো । কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা গিয়ে মিশেছে জলে । যতদূর চোখ যায় কেবলই সুবিশাল জলরাশি । মাটির কাছে, জলের কাছাকাছি নীচু হয়ে দেখলাম একটা আস্ত জলাশয় কিভাবে বৃষ্টিতে ভিজছে টুপটাপ, হাওয়ার তুলি তুলি আঙুলে আঁকিবুকি কাটছে জলের বুকে, যেন বহুকালের চেনা নিশ্চিন্ত প্রণয়ীর আশ্রয় ।

Malsej Ghat waterfall

দূরে মেঘের ওড়নার আড়ালে, পাহাড়ের ভাস্কর্য্য । হ্যাঁ পশ্চিমঘাটের এই পর্বতমালার শীর্ষদেশ ও ঢালগুলি খুব অন্যরকমের,একধরণের ভাস্কর্য্যপ্রতিম, যেন কারুর আলাদা করে নির্মাণ করা ‘পিস্ অফ আর্ট’ । পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র ছোট বড়ো ঝর্ণা, সব মিলিয়ে যেন রূপকথার রাজ্য ।
এমন বৃষ্টি আগে দেখিনি কখনো । আমাদের এখানে আকাশ কালো করে, মেঘ আসে, বৃষ্টি হয় । ওখানে দেখলাম পাহাড়ের মাথায়, আকাশের কোলে মেঘ জন্মাচ্ছে, তারপর বড়ো হচ্ছে, শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, ঝিরঝিরে জলকণা বিলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন বৃষ্টি মাখছে চরাচর । গাড়ি নিয়ে ঘন সবুজ উইন্ডোস ওয়ালপেপারের মতন ল্যান্ডস্কেপের ওপর দিয়ে যাবার সময় আমার চোখে পড়লো পাশের নীচু ঘাসের জলজ জমিতে দুটি কালো মতন কি যেন ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে ওই অবিশ্রান্ত ধারার মধ্যেই । একটু বৃষ্টির বেগ কমলে ক্যামেরা বার করতেই কয়েকবার সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উড়ে গেলো মাথার পেছনে লাল ছোপ ধরানো কুচকুচে অন্ধকার দেহের কাস্তেচরা বা Red-Naped Ibis

Red-Naped Ibis

প্রচুর ছটফটে বাবুই পাখি আর Scaly Breasted Munia চারদিকে । জলজল পথের মধ্যে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে প্লোভারের দল । ঘন চাষের জমিতে তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাক ডেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল ঠোঁট হলুদ পায়ের হাট্টিমা পাখি যার পোশাকি নাম Red-Wattled Lapwing । জলের ধারে ধারে উড়ছে tern

Little ringed plover

খুব বেশি পাখির ছবি আমি তুলিনি প্রচন্ড বৃষ্টিতে ক্যামেরা নিয়ে ভয় ছিল । লেকের পাশ দিয়ে,পাথুরে জমির ওপর দিয়ে, ঘাসের আগাছার ভিতর দিয়ে রেনকোট পরে হেঁটে যাচ্ছি একা । অনেক দূরে আমাদের গাড়ি, আশেপাশে কেউ নেই । ইচ্ছেমতন হাত দিয়ে বৃষ্টি ধরছি, মাখছি আনমনে । মাথা তুলে দেখছি পাহাড়ের মাথায় আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ার মতন ঝাপসা মেঘ, দূর থেকে দেখছি বৃষ্টি বয়ে আনছে, এই…এই…এই ব্যাস ঝুপুস করে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো ।

Malsej Ghat Hill

চুপ করে ঐভাবেই স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে আছি, বৃষ্টির বেগ এখন বড়ো বেশি, আর তেমনি হাওয়া । আমার সামনে নীচু একটা ঝোপ জাতীয় গাছের ডালে বসে বসে ভিজছে Purple-rumped sunbird, কোনোরকম স্বাভাবিক চঞ্চলতা নেই, ফুলের মধু সংগ্রহ করার ব্যস্ততা নেই । সবচেয়ে বড়ো কথা, ছোট্ট পাখিটার আমার থেকে যেন কোনো ভয় নেই । বিশাল লেন্সের আতঙ্ক নেই, দূরবীনে ওর গলার রং, মাথার পালক পরখ করার তাড়া নেই । দুজনেই ভিজতে ভিজতে দুজনকে দেখছি ঘাড় ঘুরিয়ে, যেন একই নৌকার দুই প্রান্তে বসে থাকা দুটি নির্ভয়, নিশ্চিন্ত প্রাণী । মনে মনে ওরই মতন একটা পাখি হয়ে যাই, বর্তমানটুকুকে নিয়ে জীবনযাপন করার তুচ্ছ আনন্দে লীন হয়ে যাই দুজনে ।

“সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি এল খাতার উপর
আজীবনের লেখার উপর
বৃষ্টি এল এই অরণ্যে
বাইরে তখন গাছের নীচে
নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ-গাছ ও-গাছ উড়ছে পাখি
বলছে পাখি, “এই অরণ্যে
কবির জন্য আমরা থাকি।”
বলছে ওরা, “ কবির জন্যে
আমরা কোথাও আমরা কোথাও
আমরা কোথাও হার মানিনি—”

কবি তখন কুটির থেকে
তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে মাঠের পরে
নদীর পরে
সেই যেখানে সারাজীবন
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেউ যায় যায়নি
কেউ যায় না কোনোদিনই…”

On our way back from Malsej Ghat

কবিতা ঋণ : জয় গোস্বামী

0 comments on “Malsej ghat Monsoon TripAdd yours →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *